শিশু দিবস

বিশ্ব শিশু দিবসের গুরুত্ব:
‘বিশ্ব শিশু দিবস’ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় শিশুদের নিরাপত্তা ও অধিকার প্রদানের জন্য জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে। এই দিবসের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বছরে একটি দিনের জন্য হলেও মানুষ শিশুদের নিয়ে একটু অতিরিক্ত ভাবার অবকাশ যাতে পায় সেই উদ্দেশ্যে এই দিনটি পালন করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় পৃথিবীর সব দেশ এই দিবস উদযাপন করে না। আবার করলেও অনেকে এর যথাযথ গুরুত্ব বুঝতে পারে না বা সেই অনুসারে কাজ করে না। তাই এ দিবসের মাহাত্ম্য হৃদয়ে ধারণ করে সেই অনুপাতে কাজ করার প্রয়াস চালানো উচিত আমাদের সবার।

শিশুর অধিকার:
একজন সাধারণ মানুষের মতোই একটি শিশুর অধিকার সমান। মানুষের মৌলিক অধিকার- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা এই ৫টি বিষয়কে যদি আমরা পুরোপুরিভাবে শিশুদের জন্য নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে তাদেরকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা হয়তো বা খুব কঠিন হবে না। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব শিশুকে তার প্রাপ্য অধিকার প্রদানে ব্যর্থ। দু’ বেলা দু’ মুঠো অন্নই তাদের সবার জন্য জোটে না অন্যান্য সকল চাহিদাতো পরের কথা। তাছাড়াও রয়েছে শিশুদের নিরাপত্তাহীনতার অভাব। নিরাপদ ও সুরক্ষিত জীবন শিশুর অন্যতম অধিকার। কিন্তু অস্থির এ পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত চলছে হানাহানি যুদ্ধ। যা শিশুদের জীবনকে করে তুলছে দুর্বিষহ। দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা ও নানা প্রাণঘাতী রোগ প্রতিদিনই হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু ঘটাচ্ছে। শিশুর প্রাপ্য অধিকার সমাজ যথাযথভাবে পূরণে সক্ষম হতে পারেনি। শিশুটি তখন নানাভাবে অবহেলিত ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অনেক সময় সে নির্যাতনের মাত্রা মানবাধিকারের সীমাও লঙ্ঘন করে যায়। কাজেই দেখা যাচ্ছে শিশুদের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যে অধিকারসমূহ সমাজের কাছে পাওনা। সে সব সমাজ তাদের দিতে পারছে না।

শিশুর মানসিক বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ:
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে প্রয়োজন উন্নত পরিবেশ। তাদের উপযোগী পৃথিবী আমাদের গড়ে দিতে হবে। তাদের বেড়ে উঠতে দিতে হবে অনুকূল পরিবেশে। একটি শিশু বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে শিশুদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ লাভ করতে পারবে না। শিশু মন কাদা মাটির মতো। সেই নরম মাটিতে যে ছাপ একবার লাগে তাই স্থায়ী হয়ে যায়। তাই তাদের একটি আদর্শ ও নিরাপদ পরিবেশ দিতে পারলে তারাও ভবিষ্যতে ব্যক্তিত্ববান ও আদর্শবান হয়ে উঠতে পারবে। পরিবার সমাজের একটি প্রাথমিক সংগঠন। শিশুর মেধা ও মননের বিকাশে পরিবারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার যদি শিশুদের সুরক্ষা ও সহায়তা দিতে পারে তাহলে শিশুরাও ভবিষ্যতে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যসমূহ পালনের যোগ্য হয়ে উঠবে। একটি নিরাপদ ও ভালোবাসা পূর্ণ জীবন শিশুদের জন্য নিশ্চিত করলেই কেবল তাদের যথাযথ মানসিক বিকাশ সম্ভব।

শিশু শ্রম:
শিশু শ্রম একটি ভয়াবহ অপরাধ। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে অধিকাংশ পরিবারই তাদের শিশুদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগে বাধ্য হয়। এসব কর্মজীবী শিশুরা চরম দারিদ্র্য ও বঞ্চনার মধ্যে বড় হয়। তারা উন্নত জীবন বিনির্মাণের জন্য শিক্ষা গ্রহণের কোনো সুযোগই পায় না। তারা যেসব কাজে নিয়োজিত থাকে সেসব কাজের মধ্যে কিছু কিছু আবার বেশ বিপদজনক। কিন্তু তারপরও খাদ্য চাহিদা পূরণে তাদের সকল বিপদ মাথায় নিয়েই এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে গ্রেট ব্রিটেনে কারখানা চালু হলে সর্বপ্রথম শিশু শ্রম একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চল ও মধ্য পশ্চিমাঞ্চলে গৃহযুদ্ধের পর এবং দক্ষিণে ১৯১০ সালের পর শিশু শ্রম একটি স্বীকৃত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়। আগের দিনে শিশুরা কারখানায় শিক্ষানবিস অথবা পরিবারের চাকর হিসেবে কাজ করত। কিন্তু কারখানাগুলোতে তাদের নিয়োগ, প্রকৃত অর্থে হয়ে দাঁড়ায় দাসত্ব। ব্রিটেনে ১৮০২ সালে এবং পরবর্তী বছরগুলোতে সংসদে গৃহীত আইনে এ সমস্যার নিরসন হয়। ইউরোপের অন্যান্য দেশে একই ধরণের আইন অনুসরণ করা হয়। যদিও ১৯৪০ সাল নাগাদ বেশির ভাগ ইউরোপীয় দেশে শিশু শ্রম আইন প্রণীত হয়, তবুও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উৎপাদন বৃদ্ধির প্রশ্নে বহু শিশুকে আবার শ্রমবাজারে টেনে আনে।

বাংলাদেশে শিশুদের অবস্থান:
বাংলাদেশে শিশুর অধিকার পূরণের অভাব এবং শিশুদের নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ বিরাট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘনবসতি, সীমিত সম্পদ এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। এ অবস্থায় সবচেয়ে শিশুরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সংসারে অভাব-অনটন শিশুদের শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য করে। এতে তাদের শিক্ষাজীবন নষ্ট হয়ে যায়। শিশু জীবনের সব রঙিন স্বপ্ন ও কল্পনা ধূসর হয়ে যায়, অপমৃত্যু ঘটে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার। এদেশে পাঁচ বছরের শিশুরাও নানা কাজে নিয়োজিত হয়। বিভিন্ন কল-কারখানা, ক্ষেত-খামার, বাসা-বাড়িতে তারা এসব কাজ করে এবং অনেক সময় ঠিকমতো পারিশ্রমিকও পায় না। শুধু পেট ভরে ভাত পেলেই তারা সন্তুষ্ট থাকে। অনেক সময় বেতন মিললেও তা খুবই সামান্য। তাছাড়া এসব কর্মক্ষেত্রে তারা যে নির্যাতনের শিকার হয় তা অত্যন্ত ভয়াবহ। তাদের নির্যাতনের চিত্র আমরা বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি। গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রীর হাতে সামান্য অপরাধের জন্য তারা চরম নির্যাতনের শিকার হয়। এমনকি গৃহকর্মীর মৃত্যুর খবরও পাওয়া যায়। এসব ছাড়াও মেয়ে কর্মীরা নানা যৌন নির্যাতনের শিকার হয় তাদের কর্মক্ষেত্রে। যা তাদের শিশুমনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের শিশুদের মধ্যে কেউ আবার নিয়োজিত হয় ভিক্ষাবৃত্তিতে। ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ ভয়াবহ বাঁধার সম্মুখীন হয়। এদেশেও শিশু রক্ষার নানা আইন আছে। সেসব আইন পূর্ণ রূপে বাস্তবায়ন করতে পারলে শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ নানা কাজ থেকে বাঁচানো যেতে পারে।

শিশুর নিরাপত্তা ও বিকাশে বাংলাদেশের গৃহীত উদ্যোগ:
দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, নানা দুর্যোগ প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশের শিশুদের উপযুক্ত পরিবেশ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে এদেশ সক্ষম হতে পারছে না। তবে আশার কথা হচ্ছে, বর্তমানে শিশুদের প্রতি মনোযোগ বাড়িয়েছে সরকার। তাছাড়া নানা বেসরকারি সংস্থাও গড়ে উঠেছে ঝরে পড়া কর্মজীবী শিশুদের জন্য শিক্ষা, চিকিৎসা ও অন্যান্য অধিকার প্রদানে। সরকারিভাবে শিশুদের মানসিক বিকাশে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান, যেমন শিশু একাডেমি, খেলাঘর, শাপলা-শালুক, কচি কাঁচার আসর ইত্যাদি। তাছাড়া প্রচারমাধ্যমগুলোও শিশুদের নানা অনুষ্ঠানমালা প্রচার করে- যেমন মিনা কার্টুন, সিসিমপুর ইত্যাদি। এসব অনুষ্ঠান যেমন বিনোদনধর্মী তেমনি শিক্ষামূলক।

বাংলাদেশে বিশ্ব শিশু দিবস উদযাপন:
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর উদ্্যাপন করা হয় ‘বিশ্ব শিশু দিবস’। প্রতি বছর ১ অক্টোবর এ দিবসটি উদ্যাপন করা হয়। এ উপলক্ষে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংগঠন সভা, সেমিনার, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করে। ২০১৩ সালের ‘বিশ্ব শিশু দিবসে’ বাংলাদেশের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘শিশুদের অধিকার নিশ্চিত করলে দূর হবে অন্ধকার।’





Next Post Previous Post

Contact Form